শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড: তীব্র সমালোচনা, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও ভূ-রাজনৈতিক সংকটের আভাস!
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (International Crimes Tribunal-1/ICT) কর্তৃক গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে ঘোষিত প্রথম রায়।
দণ্ডপ্রাপ্ত: শেখ হাসিনা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, উস্কানি, এবং তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগে এ রায় প্রদান করা হয়।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল উভয়ই আদালতে অনুপস্থিত (ভারতে নির্বাসিত) থাকায়, এই দণ্ড “অনুপস্থিতিতে” (in absentia) দেওয়া হয়।

রায় ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বিচার প্রক্রিয়া নিয়েই উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। দলের নেতারা অভিযোগ করেন, এই বিচার হলো একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত রাজাকারদের ফাঁসির প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা।
শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু থেকেই চরম সমালোচিত। সমালোচকদের মতে, মামলার স্বচ্ছতা নিয়ে একাধিক গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে:

বিবাদী পক্ষের জামায়াত সম্পৃক্ততা: সরকার কর্তৃক নিয়োজিত বিবাদী আইনজীবীর মধ্যে জামায়াত সম্পৃক্ততা থাকায় বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
স্বচ্ছতার অভাব: আদালতের ভেতরের একটি ভিডিও ফাঁস হওয়া এবং ২০২৪ সালের ঘটনায় ৭.৬২ ক্যালিবারের গুলি ব্যবহারের মূল উৎস বা কারণ উন্মোচিত না করা—এগুলো মামলার স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
অপরাধের দায় চাপানো: জামায়াত-শিবিরের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের থানায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মতো অপরাধে জড়িত থাকার ভিডিও স্বীকারোক্তি থাকা সত্ত্বেও সেইসব অপরাধে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করে দোষী সাব্যস্ত করায় মামলার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
তাড়াহুড়ো: তড়িঘড়ি করে রায় ঘোষণা করা হয়েছে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অনেকেই এই রায়কে ‘প্রতিশোধমূলক’ ও ‘রাজনৈতিকভাবে নির্দেশিত’ বলে মনে করছেন, যা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
আইনগত বিতর্ক ও পক্ষপাতের প্রশ্ন:
ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বাধীনতার অভাব নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলে উদ্বেগ রয়েছে।
সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন যে, ট্রাইব্যুনালে জামায়াতপন্থী বাদী ও বিবাদী আইনজীবীদের নিয়োগ দেওয়ায় এবং আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে রায় ঘোষণার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হয়নি, বরং ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার রায়কে স্বাগত জানালেও, এই রায়ের ফলে আগামী নির্বাচনের আগে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই বিতর্কিত রায় ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (OHCHR) এই ধরনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, তড়িঘড়ি করে অনুপস্থিতিতে বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী।
শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসনে থাকায় তার প্রত্যর্পণ একটি প্রধান কূটনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের বিবৃতি: ভারত সরকার রায়ের বিষয়টি ‘নজরে রেখেছে’ এবং ‘বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বলে জানালেও প্রত্যর্পণের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ঘোষণা দেয়নি বা সন্মতি দেবেন না বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পলাতক আসামিকে হস্তান্তরের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া আসলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতকে কোনঠাসা করার একটি কৌশলগত প্রচেষ্টাও হতে পারে।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং তার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে সৃষ্ট সমালোচনা, রাজনৈতিক প্রতিশোধের অভিযোগ এবং ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই রায় কার্যকর হওয়ার বিষয়টি ভারতের ভূমিকার ওপর নির্ভর করছে, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে চরম পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। একইসঙ্গে, আগামী নির্বাচনের আগে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

