আলোকিত মানুষের গল্পে-১০
জেলা নড়াইল
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মোঃ ইলিয়াস ফকির
(বিপিএম, পিপিএম, ট্রিপল আইজিপি ব্যাজ)
সাবেক উপ পুলিশ কমিশনার,
বাংলাদেশ পুলিশ।
জন্মঃ ১৭ নভেম্বর, ১৯৫৫ খ্রীঃ
মৃত্যুঃ ০৬ জুন, ২০২০ খ্রীঃ
পিতাঃ নুর মোহাম্মদ ফকির
মাতাঃ শুকুরন নেছা
গ্রামঃ ধোন্দা, ইউনিয়নঃ শাহাবাদ, থানা ও জেলাঃ নড়াইল।

তিঁনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহীনির ইতিহাসের সর্বাধিক রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত ও অত্যন্ত চৌকষ পুলিশ অফিসার।
বিশিষ্ট সমাজসেবী, সংগঠক, দানবীর হিসাবে নড়াইল জেলা সহ সমগ্র বাংলাদেশে নন্দিত ও সুপরিচিত। অত্যন্ত সুনাম ও সাহসীকতার সাথে পেশাগত দায়ীত্বপালনকালে দেশের সর্বমোট ৩৫ টি থানা সহ নিজ জেলাতে তিঁনি তাঁর জীবদ্দশায় ছোটবড় প্রায় ৪০টি মসজিদ নির্মান ও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন-সংস্কার সহ ২টি স্কুল, ২টি মাদ্রাসা, ৪টি এতিমখানা, ২ টি নৈশ বিদ্যালয়, অর্ধশতাধিক রক্তদান, স্বেচ্ছাসেবী, ক্রিড়া, বৃক্ষরোপন, বন্যপ্রানী ও পরিবেশ সংরক্ষন, আর্ত সামজিক উন্নয়ন,বাল্য বিবাহ ও নারী ও শিশু পাচার রোধ, আইনশৃংখলা রক্ষা, আত্মনির্ভশীলতায় সমবায় সমিতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের ঐতিহ্যবাহী ও দুঃসাহসিক “ঈগল টিম” এবং প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ব সমাদৃত “কমিউনিটি পুলিশিং” প্রকল্পের অন্যতম রুপকার, উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।

১৯৯১ সালে তিঁনি পেশাগত দ্বায়ীত্বে না থাকা সত্বেও নিজের জীবনের নিশ্চিত ঝুঁকি উপেক্ষা করে খুলনা হেলাতলা বাজারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে দাহ্যবস্তুপূর্ণ একটি দোকানের ভিতরে আটকে পড়া ৮ জন মানুষকে উদ্ধার করার সময় অগ্নিদগ্ধ হন, ড্রামভর্তি স্প্রিড শরীরে লেগে নিজের শরীরের ৩০ ভাগ পুড়ে গেলেও তিনি জ্বলন্ত অবস্থাতেই ৮ জনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এ ঘটনায় তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে “টাইগার অব পুলিশ” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এছাড়াও ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত যশোর কারাবিদ্রোহ, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার মুন্সীগঞ্জ গরুরহাটে ১১ জন সশস্ত্র ডাকাতের সাথে সম্পূর্ণ একা দীর্ঘ ৩ ঘন্টা বন্দুকযুদ্ধ করে জনতার সাহায্যে ডাকাতদের আটক, বাগেরহাটের রামপালে পুলিশ হত্যা মামলার ১৩ আসামী আটক, নঁওগা জেলার চাঞ্চল্যকর ১১ পুলিশ জবাই ও অস্ত্র লুটকারী আসামীদের আটক, নঁওগা জজকোর্টে বিচারককে আদালতেই হত্যার প্রাক্কালে ৩ আসামীকে অত্যাধুনিক রিমোটকন্ট্রোল বোমা সহ আটক, ঢাকা বিমানবন্দরে অভিনব কৌশলে পাচারের সময় ১৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার, খুলনা রুপসা থানার চাঞ্চল্যকর ফারুক চেয়ারম্যানের হত্যাকারীদের ৭২ ঘন্টার মধ্যে বিদেশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র- শক্তিশালী ওয়ারলেস সেট সহ আটক, পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোর জেলাকে সর্বহারামুক্ত করণ, বহুল আলোচিত জঙ্গী শায়েখ আব্দুর রহমান ও তার জামাই সানি, কুখ্যাত এরশাদ শিকদার ও তার সহযোগী নুরে আলম, বাংলাভাই, সাতক্ষীরার পাখি ডাকাত, বাগেরহাটের মুক্ত ডাকাত, দক্ষিনবঙ্গ পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির অধিনায়ক আঃ রশিদ মালিথা, ভারতীয় কিলার বোবা গনেশ, সুন্দেবনের বনদস্যু সর্দার বাঘমিয়া ওরফে বাশার, দৌলতপুরের কোরবান, নাটোরের গামা সহ অগনিত শীর্ষ দস্যু, সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও জঙ্গীদেরকে চরম সাহসিকতার সাথে গ্রেফতার করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহীনির একজন সমাদৃত ও সাহসী কর্মকর্তা হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। ২০১২ সালে তাঁরই আন্তরিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসীর সহযোগীতায় খুলনা ফুলতলায় অবস্থিত “নিষিদ্ধ যৌন পল্লী” বন্ধ করে কমপক্ষে ৩০০ সক্রিয় যৌনকর্মীদেরকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বসন্মানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা এই তিনজনই তাঁকে পৃথকভাবে নিজহাতে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করেছেন।

১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রার্থনায় আত্মসমার্পন ঘোষনা কর্মসূচীতে সারা বাংলাদেশের মধ্যে বীরমুক্তি যোদ্ধা মোঃ ইলিয়াস ফকির এর উদ্যোগেই ও তৎপরতায় সর্বাধিক ১১,৭০২ টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধঅস্ত্র সহ প্রায় ৯,০০০ চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা আত্বসমার্পন করে। চাকুরীকালে অসংখ্যবার তিঁনি সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছেন, এবং দুইবার গুলিবিদ্ধও হয়েছেন।

তিঁনি শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নিজ এলাকার প্রায় চার শতাধিক পুরুষ ও নারীদেরকে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পেতে সহযোগীতা সহ আর্থিক সহযোগীতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করেছেন।
১৯৯৮ সালে তিঁনি জেলার চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষদের চিকিৎসা সেবা ত্বরান্বিত করতে নড়াইল শহরের দূর্গাপুরের নিজ বাড়ীতে সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় আকিজ গ্রুপের আদদ্বীন এর কর্ণধর ডাঃ মোঃ মহিউদ্দিন ও ডাঃ মিনহাজুর রহমান গনের সহযোগীতায় “আদদ্বীন চক্ষুসেবা প্রকল্প” ও “মা ও শিশু প্রকল্প” বাস্তবায়ন করে দীর্ঘ ১৭ বসর জেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে বিনা খরচে চক্ষু রোগের উন্নত চিকিৎসা, ছানি অপারেশন, মা ও নবজাতক শিশু রোগের চিকিৎসা প্রাপ্তীর সুযোগ নিশ্চিত করেছেন। নিজ এলাকার বিদ্যুত, সড়ক, সেতু সহ বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ প্রাপ্তীতে তিঁনি সর্বাত্বক প্রচেষ্টা ও সহযোগীতা করে অবদান রেখেছেন।
তিঁনি মানবিক, উদার ধর্মিক হবার পাশাপাশি একজন সাহিত্যপ্রেমী ও বিদ্যানুরাগী হিসাবে জাতীয়, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে অগনিত স্মারক পুরুষ্কার অর্জন করেছেন এবং খুলনা বেতারের একজন নিয়মিত গীতিকারও ছিলেন। দেশের একাধিক পত্রপত্রিকাতেও তাঁর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা, গান ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইলিয়াস ফকির পেশাগত জীবনে চরম নিষ্ঠা, সাহসিকতা, মেধা, দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার সাথে নিজের দ্বায়িত্বপালন করে সারাদেশে নিজ জেলা নড়াইলের পরিচিতি ও সুনাম বহন করেছেন। চাকুরীজীবনে তিঁনি নড়াইলের বাইরে থেকেও সবসময় সর্বশক্তি দিয়ে নিজ জেলার মানুষ ও মানের উন্নয়নে কাজ করেছেন, নড়াইলের মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্তিম বন্ধন ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। নড়াইলের গর্বিত সন্তান হিসাবে জাতীয় ও পেশাগত জীবনে তাঁর সব অর্জনই নড়াইলের অহংকার, নড়াইলের সম্পদ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইলিয়াস ফকির এর সৃতি রক্ষার্থে পারিবারিক উদ্যোগে “বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস ফকির ফাউন্ডেশন” গঠন করা হয়েছে ২০০৯ সালে। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতি বসরে ১০ জন অস্বচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীকে শতভাগ ও ২০ জন কে আংশিক শিক্ষাবৃত্তি প্রদান সহ সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়ে থাকে। ফাউন্ডেশনের নিজস্ব অর্থায়নে নিয়মিত বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা সহ হতদরিদ্রদের আর্থিক সহযোগীতা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
৬ জুন ২০২০ তারিখে বীরমুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস ফকির হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নড়াইল জেলা প্রশাসন কর্তৃক রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর নিজগ্রাম ধোন্দা ফকিরবাড়ী পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মা ও বাবার পাশে চিরশায়িত করা হয়।

